ব্রিটেনে টিআইইআর-৪ ভিসা পদ্ধতির অপব্যবহার করে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে চলে যায়। ২০০৯ সালে এটি চালু হয়। এসব ছাত্রছাত্রীরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি পাওয়ার কথা, আসলে তা পায় না। হালে যারা স্টুডেন্ট ভিসা পাচ্ছে, বিশেষত ডিগ্রি লেভেলের নিচে, তারা মাত্র ১০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পায়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই ডিগ্রি লেভেলে নিচের ভিসায় ব্রিটেনে যাচ্ছে, কাজ পাচ্ছে না। নতুন সেমিস্টারে ভর্তি হতে দুই হাজার পাঁচশত পাউন্ড জমা দিতে হয়। একটু ভালো কলেজ হলে তিন বা চার বা তারও বেশি ফি জমা দিতে হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীই এত টাকা জমা করতে পারে না বিধায় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওখানে কাজ পেতে হলে যে ভাষাগত দক্ষতা থাকা দরকার, তা নেই অনেকেরই। ফলে হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিংবা অন্যত্র কাজ পায় না সহজে। সেসব স্টুডেন্ট ব্রিটেনে গিয়েছে, তাদের মধ্যে দশ শতাংশ ওখানকার পড়াশোনার উপযুক্ত। তারপরেও তারা যাচ্ছে। কোর্সের সাথে সামলাতে পারছে না। কোন প্রতিষ্ঠানে অবৈধ শ্রমিক খুঁজে পেলে সর্বোচ্চ দশ হাজার পাউন্ড জরিমানা দিতে হয় ঐ প্রতিষ্ঠানকে অতএব জেনেশুনে কোন প্রতিষ্ঠান এই রিস্ক নিতে রাজি হয় না, ফলে ভুয়া ছাত্ররা কিংবা ইংরেজিতে যারা কমিউনিকেট করতে পারে না, তারা কাজ পায় না ।
২০০৯ সালে ইউকে পয়েন্ট বেইজড সিস্টেমের (টিয়ার-৪) আওতায় মোট এক হাজার ৯৮৭টি কলেজের লাইসেন্স বাতিল করেছে ব্রিটেন সরকার। এর মধ্যে ২০০ কলেজের মালিক বাংলাদেশী বংশদ্ভোত এবং পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে ছিল। ইউকে বোর্ডার ফোর্স গত বছরের মধ্যে জানুয়ারিতে বাংলাদেশি মালিকানায় ৬৮টি কলেজের স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করেছে। মালিকরা এ নিয়ে শঙ্কিত (১৫ মার্চ, কালের কন্ঠ, ফারুক যোশী)। অনেক ছাত্রছাত্রী অবৈধ পথে ফ্রান্স, ইতালি,
জার্মানিতে পাড়ি জমাচ্ছে। অবৈধ পথে উন্নত বিশ্বে ঢুকতে গিয়ে অনেকের সলিল সমাধি ঘটেছে। তারপরেও থেমে নেই বিদেশে শিক্ষার্থীর যাওয়ার স্রোত।
জাপানে ভুয়া ছাত্রদের বলা হয ”উছো গাখছাই’। উছো গাখছাইদের খোঁজে জাপানি গোয়েন্দা পুলিশেরা বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে তল্লাশি চালায়। সনাক্ত করে এদের পরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। জাপানি পুলিশ যেহেতু একটু ভদ্র, তাই তারা ভুয়া ছাত্রছাত্রীদের প্রথমে দেশে চলে যেতে অনুরোধ করে, না গেলে অ্যারেস্ট করে।
আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্র বিভিন্ন দেশে যায় তারা স্বভাবতই দেশের স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়ে। অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে অনেক আদরে মানুষ হয়েছে, গোসল করার পরে কাপড়টিও নিজে ধোয় নি। এসব ছেলে-মেয়েরা বিদেশে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করে, গভীররাতে বাসায় ফিরে আবার রান্না করে। দেশে থেকে যদি এরা এর অর্ধেক পরিশ্রমও করত তা হলে দেশের চেহেরা অনেকটাই পাল্টে যেত। আমার জানামতে অনেক ছাত্র আছে যাদের ইতোমধ্যে ঢাকায় বাড়িঘর আছে, ব্যবসা আছে, তারা লন্ডনে গিয়েছে পড়তে। মাঝে মাঝে ফোন করে বলে, স্যার ফলের দোকানে কাজ করছি। অথচ এরা ঢাকায় থাকতে নিজে ফল কখনও কিনেও খায় নি, বাসার লোকজন যা কিনত, তাই খেত। লন্ডন নামের জায়গটি তাদের আকর্ষণ করে বলে সেখানে যায়। আমার এক সহকর্মীর একমাত্র ছেলে সাইপ্রাসে গিয়েছিল পড়তে, বছরখানেক পড়ে অজানা এক কারণে লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। আজও কেউ জানতে পারে নি আসলে তার কী হয়েছিল।
আমাদের ছোট এই দেশ অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভার যেন আর সইতে পারছে না। দেশও আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না উঠতি বয়সের বিদেশগামী এইসব যুবকদের দেশে রাখতে। একদিকে অবশ্য দেশের জন্য ভালো কারণ চাকুরির বাজারের ওপর চাপ কমছে। দ্বিতীয়ত, তারা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্র পাঠাচ্ছে, কমবেশি যাই হোক। অতএব এসব ছাত্রছাত্রীর ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ও সঠিক কিছু পদক্ষেপ এবং নীতিমালা তৈরি করা দরকার। শুধু এজেন্সিগুলোর ওপর নির্ভরশীল না হওয়া উচিত। তবে রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা করতে গেলেই সেখানে দুর্নীতি আর অপদস্থতা এসে হাজির হয়, এ ব্যাপারটি গভীরভাবে দেখতে হবে সরকারকে। সর্বোপরি, আমাদের দেশের মিশনগুলোর উচিত দেশের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেওয়া। কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ছে তার খোঁজখবর নেওয়া, ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলা এবং দেশকে সময় সময় আপটেড রাখা যাতে পরবর্তী সময়ে যারা যাচ্ছে তারা যাতে অন্ধকারে ঝাঁপ না দেয়। পার্টটাইম কাজের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলোর সাথেও কথা বলা উচিত। আমাদের বিদেশি মিশনগুলোর মনে রাখা উচিত, তারা দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে মিশনে চাকরি করছেন, আর বিদেশে যারা কাজ করছেন বা পড়াশুনা করছেন তারা দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখছে। বিদেশে শিক্ষা এবং কাজের বাজার আমাদের বাড়াতেই হবে, দেশের স্বার্থে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচী,
ইমেইল: mmbillah2000@yahoo.com